অদ্ভুত। আসিয়া আক্তার অপু। রোমাঞ্চভরপুর সিরিজের নতুন বই ১
প্রশস্ত একটা বাড়ি। যার আশেপাশে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু ফল ও ঔষধী গাছ। বাড়ির উত্তর পাশটায় ঘন জঙ্গল। সাদা রং করা বাড়িটা
দূর থেকে দেখায় A Hunting এর বাড়িগুলের মতো। বাড়িটা পুরনো
হলেও তার উজ্জ্বল্যটা এখোনো পুরনো হয়নি। বাড়ির সীমানা পার হলেই সামনে পড়ে একটা বেসরকারি
কলেজ। কলেজটাও বেশ পুরনো। পড়াশুনার মান যেমনি হোক ছাত্র-ছাত্রীর অভাব নেই কলেজটাতে
। সারাদিন চিৎকার চেঁচামেচি করে তারা কলেজটাকে ব্যস্ত রাখে। মাঝে মাঝে কালেজের প্রাচীরের
উপরে উঠে ফল চুরি করে খায় দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে-মেয়েরা। টাকা দিয়ে ফল কিনে খাওয়ার
চেয়ে এভাবে খাওয়ার মজাটা হয়তো একটু বেশি। ফল ছেঁড়ার সময় বার বার ওরা তাকায় বাড়িটার
দিকে। ওদের কেউ কিছু বলাতো দূরে থাক বাড়িতে কোনো মানুষের দেখাই মিলেনা। কেউ বসবাস
করে কিনা তাইবা কে জানে! অনেকের মনেই কৌতুহল জাগে বাড়িটা নিয়ে । মাঝে মাঝে আবার কেউ
কেউ গবেষণা শুরু করে দেয়। অনেকে বলে ভুতুরে বাড়ি ।
শনিবার। দুপুর প্রায় বারোটা। জুলি, কলি
আর পাপড়ি কমন রুমের পাশে দাঁড়িয়ে বেজায় গল্প শুরু করেছে। কমন রুমটা কলেজের এক কোনায়
অবস্থিত। পাশে সামান্য একটু জায়গা। যেখানে কলেজের ভাঙা বেঞ্চগুলো রাখা হয়েছে। তারপর
কলেজের প্রাচীর। প্রাচীরের ওপারে অবস্থিত ভুতুরে বাড়িটা। গল্প করতে করতে এক সময় ওদের
চোখ চলে যায় আম গাছে ঝুলে থাকা সবুজ আমগুলোর দিকে। ওরা ঠিক করে আমগুলো পেড়ে নিবে।
ভাবনার সাথে কাজ শুরু করতে সেকেন্ডও দেরি হয়না ওদের।
পাপড়ি, তুই প্রাচীরের ওপর উঠে আমগুলো
ছিঁড়ে আমাকে দে। আমি নিচে দাঁড়াচ্ছি। আর কলি, তুই ওদিকে খেয়াল রাখ। কেউ আসলে আমাদের
জানাবি। ঝটপট বলে ফেলে জুলি ।
জুলির কথা লক্ষী মেয়েদের মতো মেনে নেয়
কলি আর পাপড়ি। ডানে বামে একটু তাকিয়ে পাপড়ি প্রাচীরের উপরে উঠে পড়ে। আর নিচে দাঁড়িয়ে
পাহারা দেয় জুলি ও কলি। মাত্র দুইটা আম ছিঁড়া হয়েছে পাপড়ির, এমন সময় একটু দূর
থেকে কলেজের এক আয়া বলে ওঠে, এই তোমরা ওখানে কী করছো?
আয়ার বকা খেয়ে কলি ও জুলি দৌড়ে কমন
রুমে ঢুকে পড়ে। পাপড়ি তাড়াতাড়ি করে লাফ দিতে গিয়ে উল্টে বাড়িটার ভিতরে পরে যায়।
সেখানে ছিল কিছু ভাঙা ইট । তাতে আঘাত লেগে সেন্সলেস হয়ে যায় পাপড়ি ।
জুলি, কলি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়
। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেছে কিন্তু পাপাড়ি এখনো আসেনি। কোনো সমস্যা হয়নি তো? দুজনে
ভাবতে থাকে । টেনশনে কোনো করণীয়ই ঠিক করতে পারে না ওরা।
প্রায় পৌনে দুইটার দিকে পাপড়ি চোখ মেলে
দেখে নরম এক বিছানায় শুয়ে আছে সে। আর তার সামনে বসে আছে ঠিক রাজকুমারের মতো এক ছেলে
। পাপড়ি কিছু বলার আগে ছেলেটাই কথা বলে ।
সে বলে, তুমি আম গাছটার নিচে সেন্সলেস
হয়ে পড়ে ছিলে। আমি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। এখন কেমন লাগছে তোমার?
পাপড়ি উত্তর দেয়, জি ভালো লাগছে।
- নাম কি তোমার?
- পাপড়ি ।
- তুমি তো সামনের কলেজটার পড়। তাই না?
- জি। কিন্তু কিভাবে বুঝলেন?
- তোমার ড্রেস দেখে।
- ওওও
- কি, আম পাড়তে উঠে পড়ে গিয়েছিলে?
উত্তরটা যদিও লজ্জাজনক তবুও পাপড়ি সত্য
কথাটাই বলে । আবারও প্রশ্ন ছেলেটার, বাসায়
গিয়ে কি বলবে?
- বলেবো অটো থেকে পড়ে গেছি। আচ্ছা কয়টা বাজে? খানিকটা আতংকের স্বরেই জিজ্ঞেস
করে পাপড়ি ।
- দুটো দশ ।
- অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে ।
- পাঁচ মিনিট বসা যাবে কী? শুধু এক কাপ
চা খেয়ে যাও ।
- চা তো আমার দারুন পছন্দের। তাই কেউ চায়ের
অফার করলে আমি না বলতেই পারিনা । অনেকটা স্বাভাবিকভাবে বললো সে।
ছেলেটা চা বানাতে যাচ্ছিল এমন সময় পাপড়ি
বলে, শুনুন আমাকে ছোট কাপে চা দিবেন না। বড়
মগে। কাপে চা খেয়ে আমার মন ভরেনা।
একটু হাসি দিয়ে ছেলেটা উত্তর দেয়, ঠিক
আছে।
ছেলেটা চা বানাতে যাওয়ার পর ঘরটা ভালোমতো
দেখতে থাকে পাপড়ি। ঘরের সাইজটা বেশ বড়। তবে কোন স্টুডেন্ট এর ঘরের মতো না। সদ্য বিবাহিত
হাসব্যান্ড-ওয়াইফ যে রকম ঘরে থাকে ঘরটা
ঠিক সে রকম। বড় সরো মাপের একটা বক্স খাট,
ওয়ারড্রফ, ড্রেসিং টেবিল, সবই আছে। তবে ড্রেসিং
টেবিলে মেয়েদের সাজার মত কোন কসমেটিকস নেই। হয়ত ছেলেটার ওয়াইফ কসমেটিকস খায় না। না মানে পছন্দ করেনা ।
অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই চা বানিয়ে নিয়ে
আসে ছেলেটি। তারপর চা খেতে খেতে আবারও কিছুক্ষণ
গল্প হয় ওদের। এবার প্রথম প্রশ্নটা করে পাপড়ি।
আপনার বাসায় আর কাউকে দেখছি না যে? আর কেউ
থাকে না? আপনার ওয়াইফ টোয়াইফ, আন্টি টান্টি?
আপনি চাইলে পিডিএফ পড়তে পারেন
একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ছেলেটা বলে, না
।
- স্যরি আমি আপনার মন খারাপ করে দিলাম।
আমি আসলে জানতাম না।
- ঠিক আছে। সমস্যা নাই। আমার মন খারাপ হয়নি।
দুপুর প্রায় তিনটার দিকে বাড়ি ফেরে পাপড়ি।
বাড়ি ফিরতে না ফিরতেই প্রশ্নের মুখে পড়ে সে। পাপড়ির মা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জানতে চায়
মাথায় কী হয়েছে? পাপড়ি পূর্বের ঠিক করা মিথ্যা কথাটায় জানায় তার মাকে।
দুপুরের খাবার না খেয়ে কলেজ ড্রেস পরেই
বিছানায় শুয়ে পড়ে পাপড়ি। সন্ধার সময় ঘুম
ভাঙে তার। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ৫৬ টা মিসডকল।
তার দুই বান্ধবি ফোন দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে
গেছে। কলিকে ফোন দেয় পাপড়ি। ফোনটা ধরেই উত্তেজিত
কণ্ঠে কলি বলে, কী হয়ে ছিল রে তোর?
পাপড়ি সব কথা কলিকে বলে ।
আজিজুর রহমান স্যারের ইংরেজি ক্লাস। কলেজে
আর সব স্যারের চেয়ে আজিজুর স্যারের কিছু আলাদা বিশেষত্ব আছে। স্যার রোজ কালো প্যান্ট
আর সাদা শার্ট পরে কলেজে আসেন। শার্টের পকেটে দশ টাকার একটা লাল নোট রাখেন। বাইরে থেকে
তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই কাজটা করে স্যার কি আনন্দ পান তা শুধু স্যারই জানেন, তবে দেখতে
খারাপ লাগেনা। স্যারের এই অভ্যাসটার কারণে স্যারকে আর সবার চেয়ে আলাদাভাবে চোখে পড়ে।
এছাড়াও স্যারের আরও কিছু অভ্যাস আছে। যেমন-
গোল গোল বড় মাপের কাঁচের চশমা পরেন। প্রায়শই চশমার উপর দিয়ে তাকান। আবার কখনো নিচ
দিয়ে। হয়তো স্যারের চশমার কাচ দিয়ে পৃথিবী দেখতে ভালো লাগেনা, কিন্তু চশমা পরে নিজেকে
বেশি স্মার্ট মনে হয় স্যারের। তাই চশমা পরেন ।
ক্লাস রুমের একেবারে শেষ বেঞ্চে বসে তিন
বান্ধবি। ক্লাস শেষের অপেক্ষায় বিভোর তারা। কিন্তু ক্লাস যেন কিছুতেই শেষ হতে চায়না
। আর ওদের গল্পটাও শুরু হয় না। ক্লাস রুমের মধ্যেই আস্তে আস্তে জুলি বলে, এই পাপড়ি
আমাকে একটু শোনা, কি হলো কাল?
কথাটা যদিও আস্তেই বলেছিল জুলি তাও কেমন
করে যেন স্যারের কানে পৌঁছে গেছে। স্যারের কানের বেশ জোর আছে বলা যায় । কথা শোনা মাত্রই
স্যার তিন জনকেই দাঁড়াতে বলেন। তারপর স্যার বলেন পাপড়ি, জুলি তোকে কি যেন বলতে বলছিল?
একটু জোরে বল, সবাই একসাথে শুনি।
পাপড়ি বলে, কিছু না স্যার, এমনিতেই।
স্যার বলেন, এমনিতেই হলে তোরাও এমনিতেই
ক্লাস থেকে বের হয়ে যা।
স্যার একবার বলাতেই তিন বান্ধবি ক্লাস
থেকে বের হয়ে যায়। ওরা এমনভাবে আনন্দের সাথে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায় যেন এটাই প্রত্যাশিত
ছিল। অবশ্য এতে তাদের ভালই হয়। গল্প করার একটা সুযোগ তৈরি হয়। ওদের হাসি মাখা মুখ
দেখে স্যারের বেশ অসস্তি হতে থাকে। ওদেরকে অনুসরণ করার জন্য এক ছাত্রীকে সিআইডি হিসেবে
নিযুক্ত করেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে সিআইডি ছাত্রী খবর নিয়ে আসে। সে জানায় ওরা
বাগানে একটা গাছের নিচে বসে গল্প করছে। কথা শোনার পর স্যার আবারও সিআইডি ছাত্রীকে আদেশ
দেন ওদের ধরে নিয়ে আসতে।
স্যারের রাগটা যেন পাপড়ির উপরই বেশি।
স্যারের ধারণা পাপড়িই কলেজের সবাইকে বদ কাজে উৎসাহিত করছে। কিছুক্ষণ থামার পর চশমার
উপর দিয়ে পাপড়ির দিকে তাকিয়ে স্যার বলেন, তোরা আজ কয়টা আপরাধ করেছিস? পাপড়ি বলে,
একটা স্যার। এরপর স্যার কলির দিকে তাকিয়ে কলিকে বলেন, কলি তুই বল, কয়টা অপরাধ করেছিস?
কলি উত্তর দেয়, একটাই তো মনে হয় স্যার।
স্যার এবার যথা নিয়মে জুলির দিকে তাকিয়ে
সেই একই প্রশ্ন করেন । উত্তর টাও একই । তা হলো একটা ।
স্যার এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, তোরা আসলেই
ভেঁড়ার দল । ক্যানো জানিস? প্রথম ভেঁড়া যেদিকে যায় বাকি ভেঁড়াগুলোও সেই একই পথ
অনুসরণ করে। আমি বলছি তোরা কয়টা ও কি কি অপরাধ
করেছিস । প্রথম অপরাধ ক্লাসে কথা বলা । দ্বিতীয় অপরাধ ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে বলা মাত্রাই
বের হয়ে যাওয়া ।
স্যারের কথা শেষ না হতেই পাপড়ি বলে, স্যার
আপনার কথা পালন করেছি। ক্লাস থেকে বের হয়ে গেছি। এটা অপরাধ হলো কিভাবে? স্যার আরও
রেগে বলেন, কথার মধ্যে বাম হাত দিবি না। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। শেষ করতে দে, তারপর
বুঝাচ্ছি। স্যার আবার বলা শুরু করেন, তৃতীয় অপরাধ, ক্লাস চলাকালীন সময়ে বাগানে বসে
গল্প করা। চতুর্থ অপরাধ, আমার প্রশ্নের ভুল উত্তর দেয়া। পঞ্চম অপরাধ, কথার মধ্যে বাম
হাত। যা শুধু পাপড়ির জন্য প্রযোজ্য। এবার বলি, আমার কথা মেনে নেয়াটা কিভাবে অপরাধ
হলো। আমরা যখন পরিক্ষার সময় তোদের খাতা কেড়ে নিই । তোরা তখন কি করিস? কলি উত্তর দেয়,
খাতাটা আবার ফেরত চাই স্যার। পুনরায় লিখার জন্য ।
স্যার বলেন, তাহলে এখন ক্লাস থেকে বের
হয়ে যেতে বলা মাত্রই বের হলি ক্যানো? বলতে তো পারতি আর কথা বলবো না স্যার। ক্লাসেই থাকি ।
স্যারের কথা শেষ হওয়া মাত্রই তিনজন একসাথেই
বলে, ভুল হয়ে গেছে স্যার । ক্ষমা করে দেন।
স্যার বলেন, ঠিক আছে। তোদের ক্ষমা করে
দিতে পারি। তবে তার আগে তিনজনের তিনটা ট্রান্সলেশন করে দিতে হবে। ভুল হলে ক্ষমা হবে
না। জুলি বল, আমাকে যেতে হবে।
জুলি বলে, ঠিক আছে স্যার, যান তাহলে ।
স্যার বলেন, আমি আমার যাওয়ার কথা বলিনি।
“আমাকে যেতে
হবে” । এর ইংরেজি বল ।
কিছুক্ষণ থামার পর জুলি বলে, I
am going.
স্যার বলেন, হয়নি। কলি, তুই বল ।
কলি উত্তর দেয়, পারব না স্যার।
স্যার এবার পাপড়িকে বলেন, পাপড়ি তুই
বল । কি হবে?
পাপড়ি উত্তর দেয়, I
have to go.
স্যার বলেন, হয়েছে। কিন্তু এটা তো আমি
ওদের ধরেছিলাম। তাহলে তোকে অন্য আরেকটা সেনটেনস এর ট্রান্সলেশন করে দিতে হবে। এবার
বল, আমি জঙ্গল কেটে পুকুরে ফেলি। এর ইংরেজি কি হবে?
কোনো কিছু না ভেবে পাপড়ি উত্তর দেয়,
কাটিং ইন দ্যা জঙ্গল ফেলিং ইন দ্যা পুকুর ।
এবার স্যার বলেন, আমি তোদের মুখের ইংরেজি
শুনে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না । তাই তোদের সারপ্রাইজ দিব বলে ঠিক করেছি।
তিনজন এক সাথে বলে, কি সারপ্রাইজ স্যার?
স্যার বলেন, আমার সাথে আয়। স্যারের কথা মতো স্যারের পিছুপিছু হাঁটতে থাকে তিন জন।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা রুমের সামনে দাঁড়ান স্যার। সেই সাথে তিনজনও স্টপ ওয়াচের
মত থেমে যায় ।
এটা কী বলতো? স্যার বলেন ।
তিন জন উত্তর দেয় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের
রুম।
- কলেজ ছুটি না হওয়া পর্যন্ত তোরা এখানে
কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি । এটাই তোদের সারপ্রাইজ।
কথা শেষ করে স্যার চলে যান।
পাপড়ি বলে, ও স্যার এটাতো পানিসমেন্ট,
সারপ্রাইজ না । আপনিও ইংরেজি ভুল করেছেন ।
কান ধরে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের চেম্বারের
সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তিনজন। গল্পটা চাপাই থেকে যায় ।
সন্ধ্যাবেলা চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে
পাাপড়ির অদ্ভুত বাড়ির অদ্ভুত ছেলেটার কথা মনে পড়ে। দেখা করতে ইচ্ছে হয় ছেলেটার
সঙ্গে। কিন্তু দেখা করার কোনো উপায়ই জানা নেই পাপড়ির। আগামীকাল থেকে এক্সাম শুরু
। তাড়াতাড়ি চা খেয়ে বই খুলে বসতে হবে। কিন্তু কিছুতেই পড়তে বসতে ইচ্ছা হয় না।
পাপড়ির মাথায় পড়া থাকেনা । কিন্তু পড়ার মাথা থেকে পাপড়ির নাম ডিলিট হয় না । পরীক্ষা
শুরু হবার ২০ মিনিট পরে এক্সাম হলে আসে পাপড়ি। কোনো দিকে না তাকিয়ে কলির পাশে বসে
পড়ে সে। পরীক্ষার হলের টিচার পাপড়িকে বলেন, তোমার সিট কোথায়?
পাপড়ি উত্তর দেয়, স্যার আমরা একসাথে
ভর্তি হয়েছিলাম । পাশাপাশি রোল। সীটও পাশাপাশি হওয়ার কথা ।
স্যার বলেন, আগে তোমার সীট খোঁজো। তারপর বসো।
পাপড়ি বলে, জি স্যার।
পাপড়ির সীটটা জুলি, কলির থেকে বেশ দূরে।
দেখ মন খারাপ হয় পাপড়ির। ভেবেছিল সে একসাথ বসে দেখাদেখি করে লিখবে। কিন্তু তা হলো না।
পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘন্টা পর এক ছাত্রী
বলে, স্যার লুজ নিবো।
স্যার বলেন লুজ মানে তো ঢিলা । আমি তোমাকে
ঢিলা কিভাবে দিব? হো হো হাসির শব্দে নিরবতা ভাঙে পরীক্ষা হলের। সেই সাথে কিছুটা দেখা
দেখির সুযোগও তৈরি হয় ।
কলির পরীক্ষা আগে শেষ হয়। কিন্তু জুলি
ও পাপড়ির পরীক্ষা তখনও শেষ হয়নি। ওদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় কলিকে । পাপড়ি তখনও
কারো কাছ থেকে আমদানি রপ্তানি করার অপেক্ষায় আছে। শেষ বেল পড়লে পরীক্ষার হল থেকে
জুলি আর পাপড়ি বের হয়। কলি দুজনের কাছেই জানতে চায় পরীক্ষা কেমন হল? দুজনের উত্তরই
আশানুরুপ খারাপ।
কলি বলে, আমার সাথে একটু বাজারে চল না।
একটা হিজাব কিনব। জুলি বলে, বাব্বা! হিজাব কিনবি? এতো ভদ্র হলি কবে থেকে?
বাজারে যাবার পর নতুন নতুন থ্রি পিচগুলো
থেকে চোখ সরাতে পারেনা তিন বান্ধবি। পাপড়ি
বলে, আমার বাবার যদি একটা থ্রি পিচের দোকান থাকত !
জুলি বলে, তাহলে এক বেলা খেয়ে বাকি দুই
বেলা উপোস থাকতে হত ।
- ক্যানো ক্যানো?
সব থ্রি পিচ তো তুই একাই পরতি। না আংকেল বিক্রি করতে পারতো আর না তা থেকে কিছু আয়
হতো। জুলি উত্তর দেয়। হাঁটতে হাঁটতে একটা
হিজাবের দোকানে এসে ওরা উপস্থিত হয়। দোকানদার জানতে চায় তারা কি নিবে?
পাপড়ি বলে, আপনাদের দোকানে আযাব আছে?
. আযাব কী হবে? দোকানদার বিভৎস চেহারা
করে জিজ্ঞেস করে। পাপড়ি কলিকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ও কিনবে।
- কি সর্বনাশ! এতো ভয়ংকর জিনিস কি দোকানে
রাখা যায়? আমরা আযাব টাযাব বিক্রি করি না। অন্য কোথাও খোঁজ করেন ।
কলি পাপড়ির মাথার উপরে একটা টোকা দিয়ে
বলে, আরে গাধা আযাব না হিজাব?
পাপড়ি বলে, ওওও তাইতো।
হিজাব কিনে বাড়ি ফেরার পথে পাপড়ির চোখ
পড়ে যায় সে ছেলেটার দিকে । যাকে সে অদ্ভুত বাড়িটাতে দেখেছিল। পাপড়ি বলে, তোরা যা
আমি আসছি ।
জুলি, কলি কোন কথা না বাড়িয়ে পাপড়ির
কথা মেনে নেয় ।
ছেলেটার কাছাকাছি গিয়ে পিছন থেকেই পাপড়ি
বলে, এই, কেমন আছেন?
ছেলেটা পেছনে ঘুরে তাকায়। সাথে সাথে মুখটা
অন্ধকার হয়ে যায় পাপড়ির। এটা তো সেই ছেলেটা
না। পাপড়ি বুঝতে পারে। তারপর বলে, স্যরি; আমি আপনাকে অন্য একজন ভেবেছিলাম।
- প্রোব্লেম নেই । চাইলে আমাকে সেই ছেলেটা
ভেবে তার কথাগুলো বলতে পারেন। আমি শুনতে রাজি
আছি ।
রাগে অপমানে সে লালচে চেহারায় উত্তর দেয়,
বলব না। তারপর চলে যায় জুলি, কলির কাছে।
জুলি বলে, পাপড়ি আজ যে তোর কি হয়েছে।
সবকিছুতেই শুধু ভুল করছিস।
পাপড়ি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়
।
কলি বলে, বাসায় গিয়ে ভালো একটা ঘুম দে।
তাহলে দেখবি মাথার প্রোব্লেম ঠিক হয়ে গেছে ।
এবারও মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়
পাপড়ি ।
পরীক্ষার পর কিছুদিন বিরতি। তারপর আবার
যথা নিয়মে ক্লাস শুরু হয়েছে। পাপড়ির বাবা কামরুল হাসান পাপড়ির কলেজেরই সাইকোলজির
টিচার । খুবই সাদা মাটা মানুষ। কারো সাথে বিবাদে জড়ান না। উচ্চকাঙ্খা ও নেই তাঁর।
মেয়ে পাপড়ির ঠিক বিপরীত চরিত্রের তিনি । ক্লাস বিরতি থাকায় কামরুল সাহেব শিক্ষক
লাউঞ্জে কিছুটা সময়ের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্যার অজিদ কুমার
কামরুল সাহেব কে আদাব জানিয়ে স্যারের পাশের চেয়ারে বসেন। তারপর অজিদ সাহেব সুতোয়
বাঁধা খাতার বান্ডিল থেকে একটি খাতা বের করেন। খাতাটা পাপড়ির । অজিদ সাহেব খাতাটা
কামরুল সাহেবের দিকে এগিয়ে দেন আর বলেন, স্যার, আপনার মেয়ে পাপড়ি সংসদ ভবনকে নতুনভাবে
সংজ্ঞায়িত করেছে। সংজ্ঞাটা একটু পড়ুন স্যার ।
কামরুল সাহেব খাতাটা নেন। তারপর পাপড়ির লিখা সংসদ ভবনের সংজ্ঞাটা পড়তে থাকেন
।
পাপড়ির লিখা সংসদ ভবনের সংজ্ঞাটা এই যে,
স্যার সংসদ ভবন বুঝলেন না? সংসদ ভবন হচ্ছে
চারিদিকে পানি আর মাঝখানে ইটের তৈরি একটা বিল্ডিং।
সংজ্ঞাটা পড়ার পর কামরুল সাহেব কি বলবেন
ঠিক বুঝতে পারছেন না। শুধু মনে মনে হয়তো এটুকু ভাবছেন মেয়েটা কি কখনই ঠিক হবেনা।
কামরুল সাহেবের সংজ্ঞাটা পড়া হলে, অজিদ সাহেব খাতাটা পুনরায় বান্ডিলের মধ্যে রেখে
দেন। তারপর পুনরায় কামরুল সাহেবকে আদাব জানিয়ে চলে যান।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্লাসে অজিদ স্যার লিস্ট
দেখে দেখে রোল নম্বর আর খাতায় প্রাপ্ত নম্বর দুটোই বলে যাচ্ছেন। পাপড়ির নম্বরও সেই
লিস্টে আছে। স্যার তার নম্বরও বলেন। ভালো কথা এই যে, সে ফেল করেনি। অনেক বেশি নম্বর
না হতে পারে তবে পাশ করেছে। সবার নম্বর বলা শেষ হলে স্যার পাপড়িকে ডাকেন। তারপর জানতে
চান সে খাতায় কি লিখেছে? পাপড়ি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পাপড়ির কাছ থেকে
কোন উত্তর না পেয়ে স্যার খাতাটা বের করে নিজেই পড়ে শোনান ।
পুরো ক্লাস তখন জোরালো হাসির শব্দে ভূমিকম্পের
মতো কাঁপছে। স্যার তার সূক্ষ কণ্ঠে সেই ভূমিকম্প থামিয়ে দিয়ে বলেন, পাপড়ি তুইতো
রাজনীতি করতে চাইতি। তা এখন থেকেই কি নতুন করে সংবিধান রচনা শুরু করছিস?
পাপড়ি বলে, না স্যার এমনিতেই। পারছিলাম
না তো তাই লিখেছি।
- যে যাই বলুক। তোর সংসদ ভবনের নতুন সংজ্ঞাটা
আমর বেশ ভালোই লেগেছে। আমি ভাবছি এটা পত্রিকায় দেব। যদি উঁচু স্তরের কারো চোখে পড়ে
আর তার ভালো ভাগে তাহলে সে হয়তো পারমানেন্ট ভাবে এই সংজ্ঞাটাই রাখতে পারে। এতে তোর
ভালো একটা নাম হবে সেই সাথে পরিচিতিও বাড়বে।
- স্যার আর এরকম কিছু লিখবো না ।
- তোর মাথায় কি আছে বলতো?
- স্যার চুল আছে, খুশকি আছে কিন্তু উঁকুন
নেই ।
- উঁকুন নেই ক্যানো? ওকে একটু তোর মাথায়
আশ্রয় দে । উকুনে আমার মায়ের চরম এলার্জি স্যার। যতবার আমরা মাথায় কোথাও না কোথাও
থেকে উঁকুন এসেছে ততোবারই আমরা মা চুল কেটে দিয়েছে। সেই কারণেই তো আমর চুল ছোট ছোট।
মাঝে মাঝে যা রাগ হয় না ।
- রাগ হলে তুইও তোর মায়ের চুল কেটে দিতে
পারিস। তাতে রাগ কিছুটা কমবে ।
- না, স্যার। তা কি হয়? আমার মা আমাকে
না বুঝলেও আমি তো আমার মাকে বুঝি ।
- বুঝলেই ভাল ।
- জি, স্যার।
- পাপড়ি, তোর পড়াশোনার যা অবস্থা, আমার
তো মনে হয় তোর ভবিষ্যত কুচকুচে কালো অন্ধকার - স্যার, আপনি যদি দোয়া করেন তাহলেই
ধবধবে কালো অন্ধকারে পরিণত হবে।
পাপড়ির কথায় স্যার আর উত্তর খুঁজে পান
না। ঘন্টা পড়ে যায়। স্যার ক্লাস শেষ করে
চলে যান ।
মাঝে মাঝেই পদ্মাপাড়ের নিরিবিলি রোডগুলোতে
হাঁটতে ভালো লাগে পাপড়ির। তার দুই বান্ধবীর একজনও আজ কলেজে আসেনি। কিন্তু পদ্মাপাড়ে
আজ ঘুরার ইচ্ছাটা পাপড়ির প্রবল। তাই একাই এসেছে সে। এই জায়গাটায় কি যেনো একটা আছে।
চিরকাল বসন্ত লেগে থাকে এখানে। গাছের শুকনো পাতাগুলো ঝরে ঝরে পড়ে। তার সাথে তাল মিলিয়ে
পাখিরাও গান গায়। বারবার আসলেও মন ভরে না। ঠিক ঘুমের মতো। বারবার ঘুমালেও যেমন ঘুমের
প্রতি অবহেলা আসেনা ঠিক তেমনি বারবার আসলেও এই জায়গার প্রতি অবহেলা আসেনা। হাঁটতে
হাঁটতে পাপড়ির চোখ যায় গাছের নিচে বসে থাকা একটি ছেলের দিকে। ছেলেটা আর কেউ না সে
অদ্ভুদ বাড়ির অদ্ভুদ ছেলেটা। এক পা দু পা করে পাপড়ি এগিয়ে যায় ছেলেটার দিকে কিছু
বলার আগে আর একবার শিওর হয়ে নেয়। এই ছেলেটা সেই ছেলেটাই কিনা! কারণ এর আগে বেশ কয়েকবার
ভুল করেছে পাপড়ি । আর একটু কাছে গিয়ে পাপড়ি বলে কেমন আছেন?
পাপড়ির দিকে তাকিয়ে ছেলেটা বলে, ও তুমি?
ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
আমিও ভালো আছি । একা একা এখানে বসে কি করছেন?
- তেমন কিছু না। ঠান্ডা মাথায় কিছু ভাবার চেষ্টা করছি।
আমার সাথে একটু শেয়ার করেন, আমিও শুনি।
হয়ত ভাবার ব্যাপারে হেল্পও করতে পারি।
একটু হাসে ছেলেটা।
পাপড়ি আবারও বলে, ভালো কথা আপনার নাম
কি?
- এডওয়ার্ড
• এডওয়ার্ড? বেশ
অদ্ভুদ নামতো। আগে কখনো শুনিনি ।
- হুমমম। এডওয়ার্ড একজন আবিস্কারকের নাম। তিনি গুটি বসন্তের টিকা আবিস্কার করেছিলেন।
- ওওও। হয়তো সে টিকা দেওয়ার কারণেই আজ পর্যন্ত আমার বসন্ত
হয়নি।
এডওয়ার্ডের মুখে একটু হাসির ঝিলিক দেখা
যায়। আবারও বলতে শুরু করে পাপড়ি।
- তা আপনার এ অদ্ভুদ নামের কারণ কি?
- আমার বাবা ইলিয়াস আলী..
- আপনার পুরো নাম কি তাহলে এডওয়ার্ড আলী?
হাসি থামিয়ে এডওয়ার্ড উত্তর দেয়, আমার
ভালো নাম শাহাদত হোসেন। বাবা আমাকে এডওয়ার্ড
বলে ডাকতেন। সেই থেকে আমার নিক নেইম এডওয়ার্ড।
বাবা ছিলেন অনুপ্রাণ বিদ্যার অধ্যাপক। অনুজীব
নিয়ে কাজ করতেন। বাবা চেয়েছিলেন গুটি বসন্তের মতো কুরু রোগের প্রতিষধক আবিস্কার করতে।
তাই এক আবিস্কারের নামেই আমার নামটা রেখেছিলেন এডওয়ার্ড।
- কুরু রোগটা কি?
- কুরু একটা অণুজীব ঘটিত রোগ। যে অণুজীবের কারণে এ রোগটি হয় তার নাম প্রিয়ন ।
- প্রিয়ন!
- হুমমম প্রিয়ন। বিজ্ঞানী প্রুসিনার প্রিয়ন
আবিস্কার করেন। এটা শুধুমাত্র প্রোটিন দিয়ে গঠিত অণুজীব। এ অণুজীব মানুষের মস্তিস্কে
আক্রমণ করে।
- আচ্ছা বাংলাদেশে কি এ রোগ আছে?
- বাংলাদেশে এখনো এ রোগের সন্ধান মিলেনি।
তবে ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে এর প্রভাব বেশ।
অবশ্য সারা পৃথিবীতে এ রোগের রুগীর সংখ্যা
খুবই কম ।
- আপনি তো অনেক কিছু জানেন ।
- না, তেমনটা না ।
- আপনি পড়াশোনা কোথায় করেন?
- বগুড়া মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ
করেছি। এখন ইন্টার্নি চলছে।
- তাহলে আপনি একজন ইন্টার্ন ডাক্তার ।
- জি, মেম।
- তাহলে আমার চিকিৎসা তো ফ্রি। ঠিক না ।
ঠিক তাই
- আপনার কথা আমার অনেক মনে পড়েছে। দেখা
করতেও অনেক ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু দেখা করার তো কোনো উপায় ছিল না।
- আমারও তোমার কথা অনেক মনে পড়েছে। কিন্তু
আমারও দেখা করার কোনো উপায় ছিল না। আমরা কি মাঝে মাঝে সুযোগ মতো দেখা করতে পারি?
- অবশ্যই পারি। আপনার কন্টাক নাম্বারটা দেন। কন্টাক করে দেখা করা যাবে।
- আমি তো মোবাইল ইউজ করিনা ।
- ক্যানো?
- শব্দ দূষণের ভয়ে।
এডওয়ার্ডের কথা শুনে হাসে পাপড়ি ।
এডওয়ার্ড আবার বলে, আসলে ভালো লাগে না
।
- আসলেই আপনি অনেক আলাদা ।
- আমার তা মনে হয় না ।
- চলুন ওদিক থেকে একটু ঘুরে আসি। এক জায়গায়
বসে থাকতে ভালো লাগছে না ।
- ঠিক আছে।
কিছুক্ষণ পায়চারি করে ওরা। অনেক কথাও
হয়ে যায় তাদের। পরিচয়টা আরো নিবিড় হয়ে ওঠে। স্বপ্নগুলোও ডানা মেলতে থাকে সবুজ
সবুজ রঙে।
- কাল দেখা করবেন? জিজ্ঞেস করে পাপড়ি
।
- কখন?
- এগারটার দিকে। তাহলে কাল আর কলেজে যাব
না । সরাসরি এখানে আসবো। কারণ কলেজে একবার ঢুকলে আর বের হতে দিবে না ।
- তাই বলে ক্লাস মিস দিবে?
- এক দুই দিন ক্লাস ফাঁকি দিলে কিচ্ছু
হবে না ।
এডওয়ার্ডের সাথে গল্প করার সময় পাপড়ি
লক্ষ্য করে সবাই ওদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ঠিক এমন ভাবে যেন ওরা অন্য গ্রহের
কেউ।
এলোমেলো ভাবে কাটতে থাকে পাপড়ির দিন।
আগের চেয়ে অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে সে। সারাক্ষণ তার মাথায় এডওয়ার্ড এর চিন্তা ঘুরপাক
খায় । মাঝে মাঝেই দেখা হয় এডওয়ার্ডের সাথে। তবে তা অল্প সময়ের জন্য। কি যেন হয়েছে
পাপড়ির। কলেজেও যেতে ইচ্ছা হয়না। গেলেও আর আগের মতো মজা হয় না। সবকিছুই কেমন যেন
নিশ্চুপ লাগে পাপড়ির কাছে।
ঈদের আগে শেষ ক্লাস আজ। তারপর ঈদের লম্বা
ছুটি। পরীক্ষার রেজাল্টও আজ দেওয়া হবে। তাই কলেজে স্টুডেন্টের কোনো কমতি নেই। শেষ
দিনে ক্লাস হবেনা । এটা জানা কথা ।
পাপড়ি আর জুলি সিঁড়ির উপর বসে অলস সময়
কাটাচ্ছে। ওরা রেজাল্টের অপেক্ষায় আছে। যখন কেউ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে বা নামছে তখন
দুই বান্ধবী দুদিকে সরে তাদের যাবার জায়গা করে দিচ্ছে। ওরা চলে গেলে আবার দুই বান্ধবী
এক হয়ে বসছে। কলি এখনো কলেজে আসেনি। পাপড়ির বেশ টেনশন হচ্ছে। তবে কলির কলেজে না আসা
বা রেজাল্টের কারণে না। অন্য কারণে। আজ কলেজ ছুটি হয়ে গেলে বাসা থেকে বের হওয়ার আর
কোন উপায় থাকবে না। এডওয়ার্ডের সাথে দেখা করারও আর কোনো সুযোগ থাকবে না। হাঁপাতে
হাঁপাতে কলি এসে উপস্থিত হয় ওদের মাঝে । কলিকে দেখে জুলি বলে, কিরে হাপাচ্ছিস ক্যানো?
কিছু দেখে ভয় পেয়েছিস? নাকি কুকুরের তাড়া খেয়েছিস? কলি বলে, এমন কিছু না।
তাড়াতাড়ি আসছি তো তাই। নোটিশ বোর্ডে
বেশ ভীড় দেখলাম রেজাল্ট দিয়েছে মনে হয়। পাপড়ি বলে, তুই গিয়ে আমাদের সবার রেজাল্ট
দেখে আয় । আমরা এখানে বসে থাকি। উঠতে ইচ্ছা করছে না। কলি বলে, ঠিক আছে দেখে আসছি।
কলি চলে যাবার পর জুলি পাপড়িকে বলে, তোর তো আজ আবিস্কারকের সাথে দেখা করার কথা । যাবি
কখন?
পাপড়ি বলে, আগে কিছু আবিস্কার করতে দে
তারপর বলিস ।
- ঠিক আছে ওখানে কখন যাবি?
- রেজাল্ট দেখে চলে যাব ।
- কলিটা এখনো আসছেনা ।
- হুমমম। একটু পরেই চলে আসবে।
. ঈদের শপিং হলো তোর?
- না রে এখনো হয়নি। আসলে কেন জানিনা।
কিছুই কিনতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তোর শপিং করা
শেষ?
- একটু একটু হয়েছে ।
কিছুক্ষণের মধ্যে রেজাল্ট দেখে কলি এসে
উপস্থিত হয়। তারপর পাপড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
কংগ্রাচুলেশনস পাপড়ি। তুই তিনটা বিষয়ে ফেল
করেছিস।
কলির কথায় মোটেই খুশি না পাপড়ি। একটু রাগ রাগ চেহারায় কলিকে বলে এতে কংগ্রাচুলেশনস
জানানোর কী আছে? তোর রেজাল্টের কী খবর? কলি বলে, আমি আর জুলি দুইটাতে গেছি।
তোরা দুইটাতে? কিন্তু আমি তিনটাতে ক্যানো
ফেল করলাম। জুলি বলে, তুই বেশি ট্যালেন্ট তো
তাই ।
পাপড়ি বলে, তোরা থাক আমি চলে যাই ।
- একা একা যাস না। আংকেল যদি আমাদের দু
জনকে দেখে আর তোকে না দেখতে পায় তবে তোর কথা জানতে চাইবে। কলি বুদ্ধি দেয়।
- তা ঠিক বলছিস । তাহলে এখন কি করব?
- তিনজন একসাথে আংকেলের কাছে গিয়ে বলব,
আমরা বাজারে যাচ্ছি।
- বাবার কাছে যাওয়া যাবে না, গেলে রেজাল্টের
খবর জানতে চাইবে ।
- তাহলে?
- একসাথে তিনজন কলেজ থেকে বের হয়ে গেলে
বুঝতে পারবে না ।
- ঠিক আছে।
কলেজ থেকে বের হওয়ার পর কলি বলে, পাপড়ি
রোজ রোজ তো তুই একাই দেখা করিস । একদিন আমাদেরকেও নিয়ে চল ।
পাপড়ি বলে, তোরা গিয়ে কী করবি?
- দুলাভাই বলে ডাকবো ।
- আগে হোক তারপর ডাকিস ।
- আজ কোথায় দেখা করবি?
- পদ্মার পাড়ে।
- সাবধানে যাস।
- ঠিক আছে।
- অগ্রিম ঈদ মোবারক ।
- তোদেরকেও ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা ।
পদ্মার পাড়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল
এডওয়ার্ড। পাপড়ির যাওয়া দেখে সেও একটু এগিয়ে আসে। কুশল বিনিময় হয় দুজনের মাঝে।
এডওয়ার্ড খেয়াল করে পাপড়ির মনটা আজ একটু খারাপ । প্রতিদিনের মতো আজ এসেই কথার ঝড়
তুলেনি পাপড়ি। বরং চুপচাপ থেকে এডওয়ার্ডের কথা শোনার অপেক্ষায় আছে। হাঁটতে হাঁটতে
বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়েছে দুজন। কিন্তু কোন কথা হয়নি । এডওয়ার্ড এ নিরবতা ভাঙায়
।
এডওয়ার্ড বলে, ব্যাপার কী আজ এতো চুপচাপ?
মনটা একটু খারাপ । গম্ভীরভাবে উত্তর দেয় পাপড়ি ।
- ক্যানো কী হয়েছে? কেউ বকেছে?
- না, আজ কেউ কিছু বলেনি।
- তাহলে?
- রেজাল্ট দিয়েছে। সবাই ভালো মার্কস পেয়েছে।
- তা, তুমি কী পেলে?
- লাড্ডু, চমচম, দই এর হাঁড়ি।
- তা চেটেপুটে খেয়েছো নিশ্চয়?
- রোজা থেকে কীভাবে খাব? রেখে দিয়েছি
ইফতারের জন্য। আজ জমিয়ে ইফতার হবে।
- আমাকে ইনভায়েট করবে না?
- হুমমম, আপনিও আসতে পারেন। আমার এতো কষ্টের অর্জন একা একা খাই কিভাবে?
- থ্যাংকস, থ্যাংকস, থ্যাংকস।
- ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম ।
- অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি, এখন কী একটু বসতে
পারি?
- নিশ্চয় পারি।
পাপড়ি ব্যাগ থেকে খাতা বের করে পেজ ছিঁড়ে
নেয় বসার জন্য। এডওয়ার্ড বলে, পেজ ছেঁড়ার প্রয়োজন নাই। পাতাতেই বসা যাবে।
তারপর বড় বড় সাইজের কিছু কচুর পাতা ছিঁড়ে
বসার আসন তৈরি করে এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড বসতে
যাবে ঠিক সেই সময় পাপড়ি বলে, এই! বসেন না। কচু পাতায় বসলে চুলকাবে। জোঁকও থাকতে পারে কিন্তু।
এডওয়ার্ড একটু হাসি দিয়ে কচু পাতাতেই
বসে পড়ে। পাপড়ি খাতার কিছু পেজ ছিঁড়ে তার
উপরে বসে।
এডওয়ার্ড বলে, বেশিক্ষণ বসে থাকলেও তোমার
প্রোব্লেম। আবার হাঁটাহাটি করলেও প্রোব্লেম হয় । তাই না?
- ঠিক তাই। তারপর আপনার গবেষণা কেমন চলছে?
- একটু করে চলে একটু করে থামে। এভাবেই
।
- দেখুন এখানে কতগুলো পিঁপড়া সিরিয়াল
ম্যান্টেন করে চলেছে।
- হুমমম। কিন্তু আমরাই সিরিয়াল মেইন্টেন করে চলি না ।
- বলুনতো আমাদের চোখে সব পিঁপড়াকে একই
মনে হলেও ওরা ওদেরকে চিনে কিভাবে?
- বলতে পারলাম না।
- আমাদের চোখে যেমন ওদেরকে এক মনে হয়
তেমনি ওদের চোখেও সব মানুষকে একরকম মনে হয়। সাইজ ছোট-বড় যাই হোকনা ক্যানো আমরা যেমন
ওদের চেহারা আলাদা করতে পারিনা, ওরাও তেমন আমাদের চেহারা আলাদা করতে পারেনা। কিন্তু
আমরা যেভাবে আমাদের চিনি ওরাও ঠিক সেভাবেই ওদেরকে চিনে ।
- ঠিক বলেছো । এটা কী গবেষণালব্ধ ফলাফল?
না, আমার মনে হলো তাই বললাম ।
- হুমমম । চলো আজ একসাথে ইফতার করি ।
- কিন্তু কিভাবে? সন্ধ্যার পরতো বাসার
বাইরে থাকা মানা ।
- বাসায় ফোন করে বলো আজ আমরা বান্ধবীরা
একসাথে ইফতার করব। বলে দেখ অনুমতি দিতেও পারে। দিলে ভাল আর না দিলে কী আর করার।
- ঠিক আছে বাসায় ফোন দেই দেখি কী বলে
।
ফোনে কথা বলা শেষ হলে পাপড়ি বলে, সকালে
ভেবেছিলাম আজ কপালটা ভীষণ খারাপ। কিন্তু এখন তা মনে হচ্ছে না। অনুমতি দিয়েছে আপনার
সাথে ইফতার করার।
- ওয়াও! গুড নিউজ । কিন্তু সকালে কপাল
খারাপ মনে হলো ক্যানো?
- বাসা থেকে বের হওয়ার পর সেন্ডেল ছিঁড়ল।
বাসায় গিয়ে সেন্ডেল চেঞ্জ করে এলাম। রিকশায় উঠলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর রিকশা উল্টে
গেল। অটোতে উঠলাম। কলেজের কাছাকাছি যেতেই চাকা পাংচার। তারপর রেজাল্ট তিন বিষয়ে ফেল
। এতো কিছুর পরেও কী কপাল ভালো মনে হওয়া ঠিক?
- না । কিন্তু তোমার কোথাও লাগেনিতো?
- অল্প। খুব একটা না ।
বিকাল অবধি পাপড়ি আর এডওয়ার্ড এভাবেই
গল্প করতে থাকে । তারপর সন্ধ্যা লাগার ঘন্টা খানেক আগে এডওয়ার্ড বলে, এবার উঠি চলো।
ইফতারের সময় কাছাকাছি এসে গেছে।
- পাপড়ি, এডওয়ার্ড উঠতে যাবে ঠিক সে
সময়ে সেখানে হাজির হলো এক ফকির। জীর্ণশীর্ণ
কাপড় তার। মাথার চুলগুলো আঠালো। চামড়ায় ভাজ পড়ে গেছে। বয়স হয়েছে বেশ, বোঝা যায়। এদিকে এডওয়ার্ডের চেহারায়
কেমন যেন একটা উদার উদার ভাব আছে। সে তার উদার ভাবের চেহারার সাথে মিল রেখে ফকিরকে
১০০ টাকার একটা নোট দেয়। বেশ মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছে এডওয়ার্ড। এখন সবাই ফকিরকে
১-৫ টাকা দেয়। পাঁচ পয়সা দশ পয়সা করতে করতে এখন এ পর্যন্ত এসেছে। তবে এখনো ১০০ টাকা
দেয়ার মতো সময় আসেনি। কিন্তু ভবিষ্যতে আসবে
তা বলা যায়। হয়তো ২২০০ সালের দিকে।
ফকির ১০০ টাকার নোট পেয়ে মহা খুশি। সে সময়ে পাপড়ি বলে মন থেকে তার জন্য একটু দোয়া
করুন। যেন সে সবকিছুতে সফল হয়।
ফকির তার থুথু ঝরানো হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে
পাপড়ির কথায় সায় দেয়। এডওয়ার্ডের মাথায় হাত দিয়ে এলোমেলো ঠোঁট নেড়ে অনেকক্ষণ
দোয়া করে তারপর চলে যায়।
পাপড়ি, এডওয়ার্ড সেখান থেকে উঠে বড়
রাস্তার দিকে যায়। রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোতে তখন চপ, বেগুনি, পিঁয়াজিসহ আরও অনেক
রকম খাদ্যের সমাহার। কোনকিছুর কমতি নেই সেখানে। শহরের ব্যাস্ত মানুষগুলো সেখান থেকে
তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে শেষ বিকেলে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। এডওয়ার্ড একটা
দোকান থেকে ইফতারের প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে, তারপরে একটি রিকশায় করে পাপড়িকে নিয়ে
তাদের বাসায় যায়।
সন্ধ্যায় বাড়িটা আরও নিশ্চুপ মনে হচ্ছে।
জঙ্গলের ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো রাত নামার আগেই ডাকা শুরু করেছে। কেমন যেন একটা গা ছমছমে ব্যাপার
আছে বাড়িটাতে। মনে হয় অনেক আত্মার বসবাস এখানে। রাতে ওদের আনাগোনাও হয়তো বাড়ে ।
কারেন্ট নাই। পিডিবিতে যারা জব করে তাদের
সঠিক নামকরণ করাটা বেশ মুশকিলের। তবে এটুকু বলা যায়, তারা ইহুদি গোছের কিছু একটা হবে।
এরা ঠিক ইফতারের সময় পওয়ার সাপ্লাই বন্ধ রাখে আবার সেহরির সময়ও একই কাজ করে। কারেন্ট
না থাকাতে বাড়ির ভুতুরে ভাবটা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ডাইনিং এ বেশ বড় বড় কিছু মোমবাতি জ্বালিয়ে
খাবারগুলো প্লেটে সাজিয়ে ইফতারের আয়োজন সম্পন্ন করে এডওয়ার্ড। পাপড়ির গ্লাসে পানিও
ঢেলে দেয় সে। এতোকিছু করার জন্য এডওয়ার্ডকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল হয়না পাপড়ির। আযানের
শব্দ শোনা যায়। ইফতার করতে করতে পাপড়ি বলে, আজ প্রথমবার পরিবারের সদস্যদের ছাড়া
ইফতার করছি।
এডওয়ার্ড বলে, আমি প্রতিদিনই করি
- স্যরি, মন খরাপ হলো আপনার তাইনা?
- না । ঠিক আছে ।
- ঈদের আগে আর হয়তো দেখা হবেনা ।
- কিন্তু ক্যানো?
- আজ থেকে আমাদের কলেজ বন্ধ। বাসা থেকে
তো কোনো কারণ ছাড়া বের হতে দিবে না ।
- তাহলে তো অনেক দিন দেখা হবে না ।
- তবে ঈদের দিনে বের হতে পারব।
- ওকে। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। সত্যি
কথা বলতে কি জানো? আমরা প্রত্যেকেই এমন পছন্দের মানুষটার সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসি
।
- আমি কি আপনার পছন্দের?
পাপড়ির কথায় চুপ করে থাকে এডওয়ার্ড।
অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর এডওয়ার্ড বলে, রাত হয়ে যাচ্ছে। চলো তোমাকে বাসায় রেখে আসি
।
ঈদের দিন। সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি
পড়ছে। প্রতি ঈদের মতো হৈচৈ বা সাড়া শব্দ নেই। নিশ্চুপ হয়ে আছে সবকিছু। বৃষ্টি যেন
সবকিছুকেই থামিয়ে দিয়েছে। নেমে এসেছে স্থবিরতা।
তবে বাসায় ভালো খাবার রান্না হওয়াটা থামেনি।
রান্নার গন্ধে সিক্ত বাতাস শুধু সে সাক্ষীই দিচ্ছে।
পাপড়ি তার ছোট ভাই পলাশকে টুপি, পাঞ্জাবি
পরিয়ে ঈদগাহে যাবার জন্য তৈরি করেছে। এবার বাবার রেডি হওয়া হলেই একসাথে নামাজ পড়তে
যাবে পলাশ। মাকে রান্নার কাজেও আজ বেশ সাহায্য করেছে পাপড়ি। এটাকে এক প্রকার ঘুষ বলা
যেতে পারে। কারণ শুধু শুধু সে এতো কিছু করছেনা। এর পিছনে উদ্দেশ্য আছে। বৃষ্টি হোক
আর রোদ, ঝড় বা তুফান, বাসা থেকে আজ তাকে বের হতে হবে। কারণ এডওয়ার্ড অপেক্ষা করবে।
তাই পরিবারের সবার মন জয় করার চেষ্টা করছে পাপড়ি। আগে থেকেই সব কাজ শেষ করে রাখছে
সে। যেন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মা তার হাতে কোনো কাজ ধরিয়ে দিতে না পারে ।
নীল রঙের থ্রি-পিচটা সবে পড়া শেষ হয়েছে
পাপড়ির। এমন সময়ে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি আসেন পাপড়িদের ফ্ল্যাটে। আন্টির রান্না-বান্না
সব শেষ। তাই নতুন শাড়ি পরে পাপড়িদের বাসায় এসেছে গল্প করতে। কিন্তু পাপড়ি আন্টিকে
কিভাবে বোঝাবে যে তাঁর অন্য জায়গায় অন্য কারো সাথে গল্প করতে যেতে হবে। পাপড়ির মা
তখন ওয়াশ রুমে। তারও রান্নার কাজ শেষ। ওয়াশরুম থেকেই চেঁচিয়ে পাপড়িকে বলেন নাস্তা
দিতে। আর কী করার? আন্টির সাথে বসে থাকতে থাকতে আধা ঘন্টা শেষ হয়ে যায় পাপড়ির। আন্টি
চলে গেলে আবারও ড্রেসিন টেবিলের সামনে বসে। কিন্তু দূর্ভাগ্য! পাপড়িকে পাঁচ মিনিট
না হতেই আবার উঠতে হয়। এবার পাপড়িদের বাসায় এসেছে তার দুই কাজিন। মৌ আর মিলা। ওদেরকেও
নাস্তা দিতে হয় পাপড়িকে। কিন্তু ওদের এক কথা পাপড়ি ওদের সাথে না খেলে, ঘুরতে না
গেলে ওরা খাবেই না ।
বাধ্য হয়ে আবারও ওদের সাথে নাস্তা করতে
হয় পাপড়িকে । নাস্তা না হয় করা হলো কিন্তু ঘুরতে যাবে কিভাবে? মনে মনে কোনো উপায়
খুঁজতে থাকে পাপড়ি। খুব কষ্টে মৌ আর মিলাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ওদের সাথে বিকেলে
ঘুরবে পাপড়ি।
বারোটা দশ বাজে । এখন বাসা থেকে না বের
হতে পারলে বিকেলের আগে আর বের হওয়া হবেনা। কারণ একটু পরেই লাঞ্চ আওয়ার। কিন্তু কিভাবে
বের হবে? ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। থামার যেন নামই নেয় না। পাপড়ির আর ধৈর্য ধরার সময় নেই।
বৃষ্টি থামা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারবে না। তাই বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে
বেরিয়ে পড়ে পাপড়ি ।
এডওয়ার্ডের বাসার কাছাকাছি যেতেই ওর সাথে
দেখা হয় পাপড়ির । মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পরেছে
সে। পাপড়ি নীল রঙের থ্রি-পিচ ।
এডওয়ার্ড বলে, ঈদ মোবারক।
- আপনাকেও ঈদের
শুভেচ্ছা। হাসিমাখা স্বরে উত্তর দেয় পাপড়ি । সকাল থেকে কী এখানেই ছিলেন? এডওয়ার্ডকে
প্রশ্ন করে সে।
- হ্যাঁ, নামাজের পর থেকেই এখানে তোমার
জন্য অপেক্ষা করছিলাম
- স্যরি, অনেক দেরি করে ফেলেছি।
- ঠিক আছে। সমস্যা নাই ।
- বাসায় অনেক গেস্ট এসেছিল। ওদেরকে সময়
দিতে হলো। তাই এতো দেরি হয়ে গেছে।
- হুমমম। তুমি তো অনেক ভিজে গেছো ।
- কি করব? এখন না বের হতে পারলে বিকেলের
আগে আর বের হতে পারতাম না।
- কিন্তু অসুখ হবে তো।
- হবেনা। হলে চিকিৎসার জন্য আপনিই তো আছেন
।
- তা ঠিক। মৃদু হাসে সে।
- বাসা থেকে বের হবো এমন সময় আসল বৃষ্টি।
ঝুম বৃষ্টি। থামার নামই নেয় না। যা রাগ হচ্ছিলনা।
- আচ্ছা! তোমার রাগ হলে কী কর?
- জিনিসপত্র ভাঙি ।
- জিনিস ভাঙলে রাগ ভেঙে যায়?
- হুমমম।
- বলতো কোনোকিছু ভাঙলে রাগ ভেঙে যায় ক্যানো?
- তা তো জানি না ।
- আমি জানি জিনিস ভাঙার সাথে রাগ ভাঙার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। যখন কারও রাগ হয় আর সে জিনিস ভাঙে তখন সে একটা ক্ষতি করে। জিনিসটা ভাঙার পর সে সেটা বুঝতে পারে। যখন সে বুঝতে পারে যে সে একটা ভুল করেছে তখন তার ভেতরে একটা অনুতাপ বোধ কাজ করে। সে তখন অনুশচনা অনুভব করতে থাকে ভিতরে ভিতরে, যা সে বুঝতে পারে না বাইরে থেকে। আর এ অনুশচনা বোধের লিমিট রাগের লিমিটটাকে ক্রস করতে পারে বলেই রাগ ভেঙে যায়। ঠিক বলেছেন। (চলমান)