খালি পেটে যে সকল মেডিকেল টেস্ট করতে হয়? কিভাবে প্রস্তুতি নিবেন জেনে নিন।
চিকিৎসা বিজ্ঞান মানুষের উন্নত জীবনের সুযোগ প্রদান করছে। সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এর জন্য কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম মেডিকেল টেস্ট।
মেডিকেল টেস্ট এর মধ্যে কিছু টেস্ট আছে খালি পেটে করতে হয় আবার কিছু টেস্ট আছে ভরা পেটে করতে হয় আবার কিছু টেস্ট আছে যে কোনো অবস্থায় করা যায়। আজকে আমরা খালি পেটে যেসকল টেস্ট করতে হয় সম্পর্কে জানবো।
পেট-সিটি স্ক্যান (PET-CT / CT-PET) এর প্রস্তুতি
ক্যান্সার চিকিৎসায় যুকান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে পরিচিত পেট সিটি স্ক্যান এর প্রস্তুতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষভাবে এই টেস্টেরে প্রস্তুতি নিতে হয়। যেমন:
- টেস্টের আগের দিন রাতে ১০-১১ টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ করবে। এর পর পানি ব্যাতীত কোনো খাবার গ্রহণ করা যাবে না।
- চা, কফি, পান বা নেশা জাতীয় কোনো খাবার গ্রহণ করা যাবে না।
- পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
- যদি ডায়বেটিকস থাকে তাহলে টেস্টের দিন ভোর রাতে শুধু এক কাপ আমিষ জাতীয় স্যুপ খেতে পারবে।
- ইনসুলিন বা ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রনের কোনো ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না। ডাক্তারের পরামর্শে গ্রহণ করা যাবে।
- রোগীকে দীর্ঘ ভ্রমন, সিড়িতে যাতায়াত করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
টেস্টের সময় যেসকল বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে।
- পূর্বের টেস্টের সকল রিপোর্ট সাথে আনতে হবে। বিশেষ করে CBC, Creatinine, SGPT রিপোর্ট সাথে আনতে হবে।
- কোনো অপারেশন করা থাকলে তার রিপোর্ট আনতে হবে।
- পরীক্ষাটি করতে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে।
বোন স্ক্যান (Bone Scan) এর প্রস্তুতি
বোন স্ক্যান একটি পারমাণবিক রেডিওলজি পদ্ধতি যা বিভিন্ন হাড়ের সমস্যা নির্ণয়ের জন্য করা হয়। পরীক্ষাটির মাধ্যমে হাড়ের কোন শারীরিক বা রাসায়নিক পরিবর্তন সনাক্ত করে। পরীক্ষাটির জন্য যেসকল প্রস্তুতি নিতে হয় -
- ১ মাসের মধ্যে রোগীর Creatinine (ক্রিয়েটিনিন) রিপোর্ট থাকতে হয়।
- এই টেস্টে খালি পেটের প্রয়োজন হয় না।
- পরীক্ষাটি করতে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে।
বায়োকেমিস্ট্রি টেস্ট (Biochemistry)
জৈব রসায়নের বেশিরভাগ অংশই প্রোটিন , নিউক্লিক অ্যাসিড , কার্বোহাইড্রেট এবং লিপিডের মতো জৈবিক ম্যাক্রোমোলিকুলের গঠন, কাজ এবং মিথস্ক্রিয়া নিয়ে কাজ করে । তারা কোষের গঠন প্রদান করে এবং জীবনের সাথে সম্পর্কিত অনেকগুলি কার্য সম্পাদন করে।
প্রোটিন এবং চর্বি বিপাকের পার্থক্য, কার্বোহাইড্রেট বিপাক, এনজাইম উৎপাদন, যৌগিক ব্যবহারের ক্ষমতা ইত্যাদি কিছু কারণ যা ব্যাকটেরিয়া সনাক্তকরণে সহায়তা করে। জৈব রাসায়নিক পরীক্ষা বা বায়োকেমিস্ট্রি হলো বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার জৈব রাসায়নিক কার্যকলাপের পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে ব্যাকটেরিয়া প্রজাতি সনাক্তকরণের জন্য ব্যবহৃত পরীক্ষা।
র্যান্ডম ব্লাড সুগার (RBS) টেস্ট এর প্রস্তুতি
র্যান্ডম ব্লাড সুগার (RBS) টেস্ট এর পূর্ব প্রস্তুতিতে যা করতে হয়-
- উপবাস: নিশ্চিত করুন যে আপনি পরীক্ষার আগে কমপক্ষে 8 ঘন্টা কিছু খাননি।
- এলোমেলো: পরীক্ষাটি দিনের যেকোনো সময় করা যেতে পারে, তাই কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই।
- ওরাল গ্লুকোজ সহনশীলতা পরীক্ষা: একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্লুকোজ পান করুন এবং পরীক্ষা করার আগে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করুন।
ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) টেস্ট এর প্রস্তুতি
রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা বেশিরভাগই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে করা হয়। যদি ফাস্টিং সুগার চেক করেন, তাহলে তার সকালে পানিও পান করা উচিত নয়। ফাস্ট সুগার মানে ৮-১০ ঘণ্টা কিছু না খাওয়ার পরে রক্তের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য নেওয়া।
লিপিড প্রোফাইল (lipidprofile) টেস্ট এর প্রস্তুতি
লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করানোর আগে ৮-১০ ঘণ্টা খালি পেটে থাকুন। পরদিন সকালে ১০টায় রক্ত পরীক্ষা থাকলে আগের দিন রাতে ১০ টা তেই খাবার খেয়ে দিন। সকালে চা-পানিও খাবেন না। তবেই, কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের সঠিক মাত্রা ধরা পড়বে রক্তে।
ক্রিটিনিন (Creatinine) টেস্ট এর প্রস্তুতি
ক্রিয়েটিনিন টেষ্টের জন্য তেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। ভরা পেট কিংবা খালি পেট যে ভাবেই টেষ্ট করানো হোক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভালো মানের হলে, সঠিক ফলাফল পাওয়া যাবে।
তবে কিছু ওষুধ আছে যা কিডনি ভালো থাকলেও, রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর পরিমান বাড়িয়ে দিতে পারে—
যেমন- কিছু ব্যাথার ওষুধ (Aspirin, ibuprofen), এলার্জির ওষুধ (cimetidine), কেমোথারাপি, প্রভৃতি। এমন ওষুধ সেবন করে থাকলে, ডাক্তারকে অবশ্যাই জানাবেন।
ওজিটিটি ((Oral Glucose Tolerance Test)) টেস্ট এর প্রস্তুতি
ওজিটিটি পরীক্ষার আগে ৮ থেকে ১৪ ঘন্টা খালি পেটে থাকতে হবে। অর্থাৎ, এই সময়ের মধ্যে শুধু পানি খাওয়া যাবে, অন্য কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা যাবে না।
খালি পেটে থাকার মানে হলো রাতের খাবার খাওয়ার পর থেকে সকাল পর্যন্ত কোনো খাবার বা পানীয় না খাওয়া। শুধু পানি পান করা যেতে পারে। চা, কফি, বা যেকোনো ধরনের পানীয় খাওয়া যাবে না, কারণ এতে গ্লুকোজের মাত্রা প্রভাবিত হতে পারে।
LDL Cholesterol টেস্ট এর প্রস্তুতি
কোলেস্টেরলের মাত্রা বিশ্লেষণের জন্য রক্তের নমুনা সাধারণত রোজা অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়। তাই, ডাক্তাররা এলডিএল কোলেস্টেরল পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা নেওয়ার আগে 10-12 ঘন্টা উপবাস করার নির্দেশ দেন।
SGPT টেস্ট এর প্রস্তুতি
SGPT পরীক্ষার জন্য কোনো অতিরিক্ত প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। যে কোনও ক্ষেত্রে, আপনি যে কোনও প্রেসক্রিপশন বা ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ গ্রহণ করছেন সে সম্পর্কে ডাক্তারকে জানান। কিছু ওষুধ রক্তে ALT এর মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। ডাক্তার আপনাকে পরীক্ষার আগে কিছুক্ষণ কিছু ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতে পারেন।
ইউরিক অ্যাসিড (Uric acid) টেস্ট এর প্রস্তুতি
ইউরিক অ্যাসিড পরীক্ষার সাধারণত খালি পেটে করা ভালো, যা পরীক্ষার ফলাফলকে আরও নির্ভুল করে তুলতে পারে
গামা গ্লুটামিল ট্রান্সারেন্স (GGT) টেস্ট এর প্রস্তুতি
এই পরীক্ষার জন্য কোন বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। তবে কমপক্ষে 24 ঘন্টা আগে সমস্ত অ্যালকোহল জাতীয় খাবার পরিহার করা উচিত। এই পরিক্ষার আগে খালি পেটের প্রয়োজন হয় না। তবে কোন কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তার না খেয়ে করতে বলেন।
এছাড়াও ইনসুলিন লেভেল টেস্ট, রক্তে ফসফরাস বা ক্যালসিয়াম, কিছু হরমোন বা কার্টিসল পরীক্ষায় খালি পেটের প্রয়োজন হয়।
ইমিউনোলজি টেস্ট (Immunology)
ইমিউনোলজি টেস্ট করার আগে নির্ভুল ফলাফল পাওয়ার জন্য সঠিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন ইমিউনোলজি পরীক্ষার জন্য আলাদা প্রস্তুতির প্রয়োজন হতে পারে। নিচে কিছু সাধারণ প্রস্তুতির নির্দেশনা দেওয়া হলো:
খালি পেটে থাকা (Fasting): কিছু ইমিউনোলজি পরীক্ষার জন্য খালি পেটে থাকা দরকার হতে পারে, যেমন ইমিউনোগ্লোবুলিন টেস্ট (IgG, IgA, IgM) বা অ্যান্টিবডি টেস্ট।
সাধারণত ৮-১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হয়।
ওষুধ বন্ধ করা : কিছু অ্যান্টিবডি বা অ্যালার্জি পরীক্ষার ফলাফল ওষুধের কারণে প্রভাবিত হতে পারে। স্টেরয়েড, অ্যান্টিহিস্টামিন, বা অন্য অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ পরীক্ষা করার আগে বন্ধ করার নির্দেশনা থাকতে পারে। চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে ওষুধ গ্রহণ বা বন্ধ করুন।
খাবার এবং পানীয়: কিছু অ্যালার্জি বা অটোইমিউন টেস্টের আগে নির্দিষ্ট খাবার এড়িয়ে চলার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে। অ্যালার্জি স্কিন টেস্ট বা RAST টেস্ট করার আগে অ্যালার্জেন জাতীয় খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
পরিশ্রম বা শারীরিক কার্যকলাপ: টেস্টের আগের দিন অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক চাপ, বা ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন। এগুলো ইমিউন সিস্টেমের উপাদানগুলোতে সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে।
অ্যালার্জি টেস্টের জন্য প্রস্তুতি: অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যালার্জি কমানোর ওষুধ কয়েক দিন আগে থেকে বন্ধ করতে হতে পারে। স্কিনে কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করবেন না।
রক্ত নেওয়ার জন্য: রক্ত পরীক্ষা করার আগে হালকা বিশ্রাম নিন। পানিশূন্যতা এড়াতে পানি পান করুন (যদি ফাস্টিং দরকার না হয়)।
প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রদান করুন: যদি সাম্প্রতিক কোনো সংক্রমণ, টিকা নেওয়া, বা চিকিৎসা হয়ে থাকে, তা পরীক্ষার আগে চিকিৎসক বা পরীক্ষার টেকনিশিয়ানকে জানান। পূর্ববর্তী স্বাস্থ্য সমস্যার ইতিহাস বা বর্তমান সমস্যা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিন।
বিশেষ নির্দেশনা: কিছু পরীক্ষার আগে, যেমন ANA Test বা HLA Typing, কোনো বিশেষ খাদ্যাভ্যাস বা ওষুধজনিত প্রস্তুতি প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসকের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলুন।
পরীক্ষার ধরন অনুযায়ী প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হতে পারে। নিশ্চিত হতে পরীক্ষার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন বা ল্যাবরেটরির নির্দেশনা অনুসরণ করুন।